ঠিকানা বিহীন চলি আমি নিঃসঙ্গ এক ভবঘুরে

বাংলাদেশে এখন প্রচুর পরিমাণে মেটাল মিউজিকের ভক্ত আছে। কিন্তু আগে তো এতটা জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায় নি। তবে হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল? অবশ্যই এর পেছনে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। আর এই রহস্য উন্মোচন করতে হলে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে নব্বই এর দশকে। বাংলাদেশে এখন বেশ কয়েকটা মেটাল ব্যান্ডও আছে। কিন্তু কখনো কি কেউ জানতো একদিন এ দেশের মানুষেরাও মেটাল মিউজিক শুনে মাথা নাড়াবে? হয়তো জানতো। আর অনেকদিন ধরেই কেউ আড়াল থেকে মূল কাজটা করে যাচ্ছে বলেই আজ এর প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে জানা যাক সেই আড়ালের গল্পটা।





১৯৯৩ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড "ক্রিপটিক ফেইট", যাদেরকে হেভি মেটাল ব্যান্ড বলা হয়ে থাকে। জানা যায় ১৯৮০ এর দশকের ক্ল্যাসিক ব্যান্ডগুলোর মাধ্যমে এই ব্যান্ডটা অনুপ্রেরিত হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই সেই অনুপ্রেরণার ছাপ কাটিয়ে ভিন্ন কিছু একটা করার চিন্তা শুরু করে তারা। পরিপক্ব সাউন্ড আর অদ্বিতীয় হয়ে উঠার চ্যালেঞ্জ তাদের ভেতরের "কিছু একটা করার" জেদটাকে আরো গভীর করে দেয়। আর সেই জেদটাকে কাজে লাগিয়েই ১৯৯৫ সালে তাদের প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম "এন্ডস আর ফরএভার" রিলিজ করা হয়। পুরো অ্যালবামটাই ছিলো ইংরেজী। আমি আবারো বলছি, পুরো অ্যালবামের সবকটা গানই ছিলো ইংরেজী। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের হেভি মেটাল একটা ব্যান্ড তাদের প্রথম অ্যালবাম রিলিজ করেছে তাও পুরো অ্যালবামটাই ইংরেজী ভাষায়, ঠিক কতটা সাহস থেকে তখনকার সময়ের কয়েকটা ছেলে কত কঠিন এক কাজ করেছে "এন্ডস আর ফরএভার" অ্যালবামটাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর আমার মত অনেকেই তখনো এই পৃথিবীর আলোই দেখি নি।


আমি প্রথম "ক্রিপটিক ফেইট" এর সাথে পরিচিত হই আজ থেকে ঠিক ৭ বছর আগে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের মাঝামাঝি। সত্যি এর আগে আমার কাছে "ক্রিপটিক ফেইট" একটা নামের চেয়ে বেশি কিছু ছিলো না। কিন্তু যখনই প্রথম শুনলাম তখন থেকেই মনের গভীরে একটা খারাপ লাগা কাজ করতে থাকে। এরকম একটা ব্যান্ডকে আমি এত বছর ধরে শুনার বিন্দুমাত্র চেষ্টাই করি নি, আর আজ তারাই আমার নিঃসঙ্গ রাতের সঙ্গী, তারাই আমাকে শিখিয়ে দেয় কিভাবে বাঁচার মত বাঁচতে হয়। 


"ক্রিপটিক ফেইট" - কে নিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক তাহলে। একদম অন্ধকার একটা স্টেজ। কিছুক্ষণ আগেও স্টেজে আলো ছিলো, অন্য একটা ব্যান্ড পারফর্ম করে গেল। তারপর হঠাৎ করেই আলো নিভে গেল। আমার ডানে কিংবা বামে অবস্থানরত সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন একটা অবস্থা যে মনে হচ্ছে এখনই আলো জ্বলবে আর সবদিক থেকে একসাথে আক্রমণ শুরু হবে। মোবাইলের আলো যেসব চোখে গিয়ে পড়ছে সেই চোখগুলো ভয়াল কিছু চায়, আরো বেশি কিছু। সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্টেজে আলো জ্বললো। মাত্র চারটে মানুষ স্টেজে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আসলেই কি ওরা চার জন? আরে না, মাত্র চার জন হবে কেন? স্টেজের সামনে তো হাজার হাজার ছেলে- মেয়ে চিৎকার করছে। তবে ওরা আসলে কি চায়? ওরা চায় শহরের যান্ত্রিকতা ছাড়িয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে। ওরা চায় চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটা এক একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আর কতদিন এভাবে সহ্য করবে? এবার তো সত্যিই সময় এসেছে পাল্টা আক্রমণের। অথবা যে ছেলেটা পরিবার - পরিজন হারিয়ে যাওয়ার পরেও ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করেছিলো তার ভালোবাসাটাও ভোরের আলোয় পালিয়ে গেল। এই ছেলেটা এখন ভবঘুরে, ঠিকানা বিহীন এক পথচলা শুরু হয়েছে তার। এখন হয়তো তাদের গানে নিজের ভেতরে জমা দুঃখ কষ্ট সব ঝেড়ে ফেলবে।


সত্যি মনে হয়েছে একদম চোখের সামনে চারটা জ্যান্ত তরতাজা জীবন দেখেছি। দেখেছি এই চারটে মানুষকে যারা পরাজয়ের ভয়ে বসে না থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করার শক্তির যোগান দেয়। যারা আমাদের শেখায় কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। কিংবা নিঃসঙ্গ ভরঘুরে পথিকের কষ্টটা একটু হলেও কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কনসার্ট শেষে বের হওয়ার সময় আমার হাতে ছোট্ট একটা পানির বোতল ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু আমার মুখের হাসি দেখেই বুঝা সম্ভব অনেক বড় কিছু একটা নিয়েই বের হয়েছি যা ইতিমধ্যেই বুকের গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। আমার ভাঙা গলার স্বরও বলে দেয় ঠিক কতটা চিৎকার করে আজ আক্রমণ করেছি শত্রুপক্ষকে।


আমার মত প্রায় অনেকেই এমন অভিজ্ঞতার স্বাক্ষী। বিশ্বাস করুন আমরা কেউ শূন্য হাতে বের হই নি, সাথে করে নিয়ে ফিরেছি অনেক বড় কিছু। আমাদের বদলে যাবার মূলমন্ত্রটা আমরা এতদিনে হাতের মুঠোয় বন্দী করতে পেরেছি। শহরের যান্ত্রিকতায় লুকিয়ে থাকা প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস কিংবা কষ্টের চিহ্ন আজ পালিয়েছে অনেক দূরে। কারণ আমরা এখন জানি কিভাবে বীরের বেশে বুক ফুলিয়ে ন্যায়ের পথে সমাজে চলতে হয়। আমার মত যারা কিছু একটার স্বাক্ষী হয়েছিলো তারা এমন রাতগুলো ভুলবে না। এমনকি ভুলার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করবে না। এসব রাত যে ভুলার জন্য না।


বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক ইতিহাসের সবচেয়ে সফল এই ব্যান্ডটা এখন পর্যন্ত চারটে অ্যালবাম রিলিজ করছে। ১. এন্ডস আর ফরএভার ২. শ্রেষ্ঠ ৩. দানব ৪. নয় মাস।  


তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো "ক্রিপটিক ফেইট" এর কম্পোজিশন যেমন আপনার রক্ত গরম করে দিতে পারে তেমনি আবার পারে নীরবে প্রতিবাদের রাস্তাটাও দেখিয়ে দিতে। "প্রতিবাদ" গানটাই এর বাস্তব উদাহরণ। জয় বাংলা কনসার্ট এর মত বড় বড় কনসার্টগুলো জমিয়ে দিতে "ক্রিপটিক ফেইট" এর বিকল্প এখনো কেউ চিন্তা করতে পারে না। 


ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপঃ১. শাকিব চৌধুরী (ভোকাল, বেজ)। ২. কে. সারফারাজ (গিটার)। ৩. ফারহান সামাদ (গিটার)। ৪. রায়েফ আল হাসান রাফা (ড্রামস)। ৫. অভিজিৎ ঘোষ (ড্রামস)। 

অভিজিৎ ঘোষ গেস্ট ড্রামার হিসেবে "ক্রিপটিক ফেইট" - এ আছেন। রাফা'কে কিছুদিন দেখা গেলেও মধ্যে কয়েকটা কনসার্টে ড্রামস বাজিয়েছেন অভিজিৎ ঘোষ।


এছাড়া অনেকেই জানেন না এই সময়কার জনপ্রিয় অভিনেতা ইরেশ জাকেরও একটা সময় "ক্রিপটিক ফেইট" - এ কাজ করেছেন। এবং ফারশিদ মাহমুদ এর মত শক্তিশালী ড্রামার, ওয়াহিদ্দুজামান খান এর মত মিউজিসিয়ান এই "ক্রিপটিক ফেইট" - এ ছিলেন যাদেরকে আজও ভক্তরা খুঁজে বেড়ায়। 


এইতো গত কয়েকদিন আগেই হেভি মেটাল এই ব্যান্ড তাদের সর্বশেষ অ্যালবাম "নয় মাস" এর "রাতের শেষ" গানটার মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে প্রকাশ করেছে। গানের পাশাপাশি এক একটা মিউজিক ভিডিও জনপ্রিয় এই ব্যান্ডের যোগ্যতার প্রমাণ দেয়। "আক্রমণ", "রাতের শেষ" এর মত মিউজিক ভিডিও এর আগে বাংলাদেশের কোন ব্যান্ড তৈরি করতে পারে নি। তাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ঘুরে আসলেই সেটা বুঝা সম্ভব।


এই প্রজন্মের শ্রোতা যারা মেটাল মিউজিক নিয়মিত শুনেন এবং মেটাল মিউজিক করারও চেষ্টা করেন তাদের কাছে "ক্রিপটিক ফেইক" অনেক বড় এক ভরসা এবং অনুপ্রেরণার নাম। আমরা আজ যারা "ভবঘুরে", "আক্রমণ", "দানব" কিংবা "প্রতিবাদ" শুনে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতে পারি তেমনি আমাদের পরের দুই প্রজন্মের শ্রোতা যারা তৈরি হবে তাদের কাছেও "ক্রিপটিক ফেইট" অনুপ্রেরণা যোগাবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু তখন হয়তো আমাদের মত কনসার্ট দেখে বুকের বামটায় কিছু একটা নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে পারবে না। কারণ আজকের এই জলজ্যান্ত মানুষগুলো বয়সের ভারে একটা সময় স্টেজ কাঁপানোর শক্তিটা হারিয়ে ফেলবে।সবশেষে একটাই চাওয়া এই হেভি মেটাল ব্যান্ডটা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। এবার সময় এসেছে আমাদেরও তাদেরকে কিছু দেবার। ইতিমধ্যে কেউ কেউ ঋণের ভারী পাল্লাটা একটু কমাতে চাচ্ছেন আর এজন্যই আন্ডারগ্রাউন্ড অনেক কনসার্টে ছোট ছোট ব্যান্ডগুলো "ক্রিপটিক ফেইট" - কে এখন ট্রিবিউটও দেয়।


ভালো থাকুক শাকিব চৌধুরী, ফারহান সামাদেরা, ভালো থাকুক নব্বই দশক থেকে আমাদের প্রথ প্রদর্শক হয়ে উঠা জীবন্ত কিংবদন্তীরা।




Comments

Popular posts from this blog

পুরনো ঠিকানায় আর্বোভাইরাস!

শুভ জন্মদিন জুনায়েদ ইভান