কেন তামিমকে নিয়ে এত সমালোচনা?


তামিম ইকবালকে নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে যে পরিমাণ সমালোচনা হচ্ছে সেটা কি ঠিক? না মানে, কোন ক্রিকেটারই সমালোচনার উর্ধ্বে নয় এটা আমি মানলাম। খারাপ খেললে সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েকটা দিনের অফফর্মে তার ১৬ বছরের কীর্তি, ক্যারিয়ার সব ভুলে যাবো? নাকি ইচ্ছে করেই সবকিছু চোখের সামনে পরিষ্কার জলের মত ভাসলেও তামিমকে নিয়ে সমালোচনা করতে হবে, ট্রল করতে হবে? বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তামিমের চেয়ে বেটার ওপেনার আর একজনও নেই। আধৌ আসবে কিনা সেটাও এখন বলা মুশকিল। তবে কেন তামিমকে গলার কাঁটা ভাবছে কিছু নব্য ক্রিকেট ভক্ত সে প্রশ্নেরই উত্তর খু্ঁজতে চেষ্টা করছি। 



উত্তর জানতে আপনাকে ফিরে যেতে হবে ২০২০ সালের শুরুর দিকে। পুরো বিশ্বে তখন করোনা মহামারি। খেলাধুলা বন্ধ, প্রতিনিয়ত খবর আসছে একের পর এক প্রাণ ঝড়ে যাওয়ার। অন্য সবার মত এগিয়ে এসেছিলেন তামিম ইকবালও। বরং অনেকের চেয়ে একটু বেশিই এক্টিভ ছিলেন বাংলাদেশী এই ড্যাশিং ওপেনার। অসহায়, অবহেলিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চট্টলার "কলিজাওয়ালা খান।"



কেবল যে মানুষকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন এমন না, মহামারিটা কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে, মানুষকে নিছক বিনোদন দিতে নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে নিয়মিত লাইভ আড্ডা শুরু করেন তামিম। তামিমের এই লাইভ আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন দেশী বিদেশী অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা। মাশরাফি, মুশফিক, রিয়াদদের পাশাপাশি তামিমের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন অধিনায়ক বিরাট কোহলি, কিউই কাপ্তান কেন উইলিয়ামসন, ফাফ ডু প্লেসি সহ অনেকেই। ছিলেন না কেবল একজন, তার নাম সাকিব আল হাসান। 



অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন তামিমের এই লাইভ আড্ডায় তার পুরাতন আর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাকিবকেও দেখা যাবে। কিন্তু সে সময়ে আমেরিকায় অবস্থান করা সাকিবকে তামিমের লাইভ আড্ডার কোন এপিসোডেই দেখা যায় নি। স্বভাবতই সাকিব আল হাসানের ভক্তদের বেশ মন খারাপ হয়েছিলো। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন সাকিব-তামিমের সেই পুরনো বন্ধুত্বটা আগের মত নেই। না হলে অবশ্যই সাকিবকে আমন্ত্রণ জানাতেন তামিম। 


সাকিব আল হাসানের ভক্তরা এই ঘটনার পর থেকেই তামিম ইকবালের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া শুরু করেন। তার আগে পর্যন্ত সবকিছু প্রায় ঠিকঠাকই ছিলো। এরপরের বছর থেকেই ক্রিকেট আবারো মাঠে ফিরে। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরেন বাংলাদেশের পোস্টারবয় সাকিব আল হাসান। মিডিয়ায় খবর বের হয় সাকিব-তামিমের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। আগের মত আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই তাদের মাঝে, তৈরি হয়েছে দূরত্বের। দিন দিন দুই বন্ধুর এই দূরত্ব বাড়তেই থাকে। আগের বছরগুলোর মত তামিমের ব্যাটেও ছিলো না নিয়মিত রান। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরত আসা সাকিব ব্যাটিংটা ঠিকঠাক করতে না পারলেও বোলিংয়ে ঠিকই ছিলো আগের ধার। সুযোগটা কাজে লাগান নব্য ক্রিকেট ভক্তরা। বিশেষ করে যারা নতুন করে সাকিব আল হাসান ভক্ত হয়েছিলেন তারা একটু একটু করে সুযোগ পেয়ে বসেন তামিম ইকবালকে ট্রলের সাগরে ভাসানোর। ফ্যানদের এমন ট্রলটা একটা সময় গিয়ে বর্তায় দেশের ক্রিকেটের নীতিনির্ধারক পর্যন্ত। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিয়মিত না খেলা তামিমকে ছাড়াই এগোতে থাকে বিশ্বকাপের পরিকল্পনা। নিজেকে আরো দূরে সরিয়ে নেন তামিম নিজেই। ফেসবুক বার্তায় জানিয়ে দেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা খেলছেন না তিনি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আর টাইগারদের জার্সিতে দেখাও মিলেনি তামিমের। বরং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে থাকা তামিম হুট করেই একদিন বিদায় জানিয়ে দেন ক্রিকেটের এই ক্ষুদ্র সংস্করণকে। 



তামিমের এমন সমালোচনা আর ট্রল হওয়ার পেছনের কারণ যে সাকিব আল হাসানের নব্য ভক্ত এমনটা বলছি না। তবে শুরুটা হয়েছিলো তাদের হাত ধরেই। কারণ বাংলার ক্রিকেটে অনেকদিন ধরেই আমরা দেখে আসছিলাম ক্রিকেটারদের আলাদা ফ্যানবেস। কেউ তামিমিয়ান, কেউ সাকিবিয়ান তো আবার কেউ মুশিয়ান। একজন খারাপ করে তো অন্য জনের ভক্তরা তাকে নিয়ে ট্রলিংয়ে মেতে উঠে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় শুরু হয় সমালোচনার। কমেন্ট বক্সে শুরু হয় যুক্তিতর্কের খেলা, অনেক সময় নিজের পছন্দের ক্রিকেটারকে ডিপেন্ড করতে গিয়ে কেউ কেউ আরেকজন ক্রিকেটার বা তার ফ্যানবেসকে গালিগালাজও শুরু করেন। 



সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছিলো ওডিআই কাপ্তান তামিমের। নিজের স্বভাবচরিত ব্যাটিংটা করতে পারছিলেন না, নিয়মিত রান ছিলো না ব্যাটে। দিনদিন স্ট্রাইক রেটটাও কমতে শুরু করে। তামিম হ্যাটার্স বলি বা সমালোচকই বলি তাদের তখন মূল অস্ত্রই ছিলো তামিমের স্ট্রাইক রেট। তার নাম দেয়া হয় "ডটবাবা।"একটা আলাদা গ্রুপ তৈরি হয় যাদের কাজই হলো সবকিছুতেই তামিমের দোষ খুঁজে বের করা। ব্যাটে নিয়মিত রান না থাকলেও অধিনায়ক তামিম ঠিকই কাজের কাজটা করে যাচ্ছিলেন ঠিকঠাক। কিন্তু দিনশেষে তবুও তাকে কথা শুনতে হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। তামিমের মত একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার নিশ্চয়ই এসব এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেটা কতদিন? একটা মানুষকে নিয়ে যখন দিনের পর দিন ট্রল করবেন, তাকে নিয়ে সমালোচনায় মাতবেন একটা সময় ঠিকই এমন কিছু ব্যাপার তার কনফিডেন্সে আঘাত করবে। আঘাত করবে তার লড়াকু মানসিকতায়। দিনশেষে এই মানুষটাও তো রক্তে মাংসে গড়া একজন।



কিন্তু তামিম কি সেটা ডিজার্ভ করেন? কতজন এভাবে চিন্তা করেছেন? নব্য ক্রিকেট ভক্তরা হয়তো ৫-৬ বছর আগের তামিমকে সেভাবে দেখেননি কিন্তু তাদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে যারা একজন তামিম ইকবালের সেক্রিফাইস, পরিশ্রম, অর্জনগুলোকে ছোট করছেন তারা নিশ্চয়ই একদিন নিজের ভুলটা বুঝতে পারবেন। 



আমি বলছি না এসব ইস্যুতেই তামিম অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তামিমের অবসরে যাওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্ত হিসেবে, একজন ক্রিকেট ভক্ত হিসেবে আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গাটা কি ঠিক আছে? 



এইতো কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম অনেকেই তামিমের অবসর চেয়েছেন, তামিমকে ক্যাপ্টেন্সি ছাড়তে বলেছেন কিন্তু কারণটা ঠিক? বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক বলা হয় মাশরাফি মর্তুজাকে। কিন্তু আপনারা ভুলে গিয়েছেন মাশরাফির পরেই ২য় সর্বোচ্চ সফলতা এসেছে অধিনায়ক তামিমের হাত ধরে! দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে প্রথমবারের মত সিরিজ জয়, ঘরের মাটিতে ভারতের সাথে সিরিজ জয়, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তানের সাথেও জয়। ওডিআই সুপার লীগে তিন নম্বরে বাংলাদেশ। তবুও কেন অধিনায়ক তামিম আপনাদের চোখে ভিলেন? 


আসলে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সমস্যাটা হচ্ছে মেন্টালিটির। আপনারা একজন তামিম ইকবালকে অস্বীকার করলেও তার কীর্তি, পরিসংখ্যান এগুলোকে অস্বীকার করতে পারবেন না। পারবেন না ২০১৮ এশিয়া কাপে ভাঙা হাত নিয়ে মাঠে নামা তামিমের বীরত্বকাব্যকে অস্বীকার করতে। 


আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অভিমানে বিদায় জানানো তামিম হয়তো আরো কয়েকটা বছর দেশকে সার্ভিস দিতেন। তিনি চেয়েও ছিলেন যাবার আগে দেশকে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার। কিন্তু সেটা আর হলো কোথায়? আমরা এমন একটা জাতিতে পরিণত হলাম যারা কিনা ক্ষণিকের ব্যর্থতায় একজন কিংবদন্তির পুরো ক্যারিয়ারটাই ভুলে যেতে চাই। 



লেখাঃ দুর্জয় দাশ গুপ্ত 

Comments

Popular posts from this blog

পুরনো ঠিকানায় আর্বোভাইরাস!

শুভ জন্মদিন জুনায়েদ ইভান

ঠিকানা বিহীন চলি আমি নিঃসঙ্গ এক ভবঘুরে