শুভ জন্মদিন জুনায়েদ ইভান
পৌষ সংক্রান্তির শীতের রাত, সময়কাল ২০১৫। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কনসার্ট। লাইনআপে আর্বোভাইরাস, লালনের মত জনপ্রিয় ব্যান্ড।উঠতি ব্যান্ড হিসেবে প্রথমবারের মত সিলেটে পারফর্ম করতে এসেছে অ্যাশেজ। গ্রীন রুমের সামনে মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর অ্যাশেজের দেখা পেলাম। পারফর্ম করার জন্য স্টেজের দিকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে পুরো অ্যাশেজ ব্যান্ডটা। সে সময়টাতেও সেইম একই লাইনআপ। জুনায়েদ ইভান, সুলতান রাফসান খান, তৌফিক আহমেদ বিজয়, ওয়াহিদুজ্জামান তূর্য, আদনান বিন জামান সাথে অ্যাশেজের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার রিফাত বিন রাশিদ। গ্রীন রুমের সামনে জুনায়েদ ইভানের জন্য বেশ আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ৫-৭টা ছেলের মধ্যে আমিও একজন। তখন আসলে অ্যাশেজের এতটা হাইপ ছিলো না। তাদের প্রথম অ্যালবামের গানগুলো জাস্ট কিছু মানুষ শুনতে শুরু করেছে। যাই হোক, গ্রীন রুম থেকে স্টেজে যেতে যেতে জুনায়েদ ইভানের সাথে দুই-চারটা কথা হলো।
কনসার্ট শেষ হতে হতে রাত বারোটা বা সাড়ে বারোটা এমন হবে। সিলেটে তখন শীতের রাত মানেই ঘন কুয়াশা। অপেক্ষা করলাম রাত একটা পর্যন্ত। আবারো দেখা হলো জুনায়েদ ইভানের সাথে। মিনিট দশেকের মত কথাও বললাম। এই সুযোগে নিজের পরিচয়টা দিয়ে উনার ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারটাও যোগাড় করে নিলাম। সম্পর্কের শুরুটাও এখানেই।
তার ঠিক মাস দেড়েক পরে আবারো সিলেটে অ্যাশেজ। সারা দেশেই তখন অ্যাশেজের জোয়ার শুরু হচ্ছে। জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এবারের আয়োজনে লিডিং ইউনিভার্সিটির জনপ্রিয় মিউজিক্যাল ক্লাব ব্যান্ড কমিউনিটি। কনসার্ট হবে রিকাবী বাজারের নজরুল অডিটোরিয়ামে। জুনায়েদ ইভানের সাথে শো এর আগেরদিনই কথা পাকাপাকি হলো কনসার্টের দিন আলাদাভাবে দেখা করতে হবে। কলেজ শেষ করে বাসায় গিয়ে বের হতে হতে খবর পেলাম অ্যাশেজ অলরেডি সিলেটে পৌঁছে গিয়েছে। ইভান ভাইকে ফোন করে জানতে পারলাম উনারা পানশি'তে লাঞ্চ করছেন। দ্রুত সাথে থাকা ৪-৫টা বন্ধুদের নিয়ে জিন্দাবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা। কিন্তু আমরা যেতে যেতেই লাঞ্চ শেষ করে হোটেলের পথে অ্যাশেজ। হুট করে লক্ষ্য করলাম আমি যে রিকশায় ছিলাম তার বিপরীত দিক থেকে আসা রিকশায় ইভান ভাই আর তূর্য ভাই। দিলাম এক চিৎকার... এক চিৎকারে রিকশা দাঁড় করালেন ইভান ভাই। দুটো রিকশায় করে যাওয়া আমরা ৫ বন্ধু মিলে উনাদের সাথে ছবি তুললাম, কয়েক মিনিট কথাও বললাম।
রিকশা থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোলা সেই ছবি।
রাত বারোটা পর্যন্ত কনসার্ট দেখে ক্লান্ত হয়ে বাসায় গিয়ে ঘুম। এক ঘুমে পরদিন দুপুর। ফেসবুকে দেখলাম অ্যাশেজ অলরেডি সিলেট ছেড়ে ঢাকার পথে। কিন্তু আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আগেরদিনের কনসার্টের ক্রেজটা তখনো আছে। একটু পরপর কনসার্টের ভিডিও দেখছি, ইভান ভাইয়ের সাথে তোলা ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছি। হুট করে ফেসবুকে একটা নোটিফিকেশন দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছেন জুনায়েদ ইভান। প্রথম কয়েক মিনিট যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বন্ধুরা আমাকে ভাগ্যবান বলে আরো কত উপাধি দিয়ে দিলো ততক্ষণে। তখন আসলে একটু একটু করে মনে হতে শুরু হলো জুনায়েদ ইভানের সাথে আসলে আমার সম্পর্কটা ভাই-ভাই পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ঐদিন রাতেই আবার ফোনে কথা হলো। মনে হলো এই মানুষটা কত আপন, অথচ গিটার নিয়ে যখন স্টেজে দাঁড়ায় মনে হয় কত বড় একটা রকস্টার।
সবচেয়ে মজার একটা রাত কাটিয়েছিলাম সুনামগঞ্জে। তখন ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার জন্য অ্যাশেজকে আনা হয়েছিলো। সিলেট থেকে আমার ৬টা বন্ধুকে নিয়ে কনসার্ট দেখতে গিয়েছিলাম। সেই বিকেল থেকে অপেক্ষা করতে করতে অ্যাশেজ স্টেজে উঠলো রাত দশটায়। কনসার্ট শেষ হলো সাড়ে এগারটার দিকে। জুনায়েদ ইভান সহ অ্যাশেজের এরপরে অবস্থান ছিলো গ্রীন রুমে। আমি গ্রীন রুমে যেতে চাচ্ছি কিন্তু আয়োজক কমিটির সদস্যরা কিছুতেই ভেতরে যেতে দিবে না, গেটে আটকে দিলো আমাকে। আমি বারবার বলে বুঝানোর চেষ্টা করলাম ইভান ভাই আমার সাথে পারসোনালি পরিচিত, উনি আমাকে ডেকেছেন। কিন্তু আয়োজকরা কিছুতেই বুঝতে রাজি না। বাধ্য হয়ে ইভান ভাইকে ফোন করে বললাম, ভাই গেটের বাইরে আটকে আছি। উনি নিজে গেটে এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। এরপর আড্ডা দিয়ে সারা রাত লঞ্চঘাটে লঞ্চে বসে কাটিয়েছিলাম সব বন্ধুরা মিলে। আহা, কি মধুর স্মৃতি!
২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি আমরা বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করলাম একটা চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজন করবো। শীতার্ত মানুষের জন্য আমরা এই কনসার্ট থেকে আসা অর্থ দিয়ে কিছু একটা করবো। কিন্তু ভালো ব্যান্ড না থাকলে তো মানুষ টিকেট কেটে শো দেখতে আসবে না। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে আমরা কনসার্ট নামালাম। হেডলাইনার অ্যাশেজ। সবমিলিয়ে দশটা ব্যান্ড। অ্যাশেজ তখন তুমুল জনপ্রিয়। প্রতিদিন কনসার্ট করছে। তাদের পেমেন্টও লাখের উপরে। কিন্তু এত টাকা দিয়ে অ্যাশেজকে আনলে তো আমাদের পুষাবে না। জুনায়েদ ইভানকে নিজের বড় ভাই মনে কর সব জানানোর পরে উনিও মাত্র ৩০ হাজার টাকায় শো করতে রাজি হলেন। ফোনে ওপাশে থাকা জুনায়েদ ইভান নিজেই বললেন, "দুর্জয় তোর জন্য এই কনসার্টটা অ্যাশেজ করবে। তোরা মানুষের জন্য কিছু করতে চাস এজন্যই আমরা আসবো।" সেদিন বুঝতে পারলাম এই মানুষটা আমাকে কতটা আপন ভাবে। অ্যাশেজ আসলো, আবারো সিলেট জয় করলো।
অ্যাশেজ আর জুনায়েদ ইভান কিভাবে মাত্র দিন কয়েকের ব্যবধানে পুরো দেশে ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে সেটা নিজ চোখে দেখেছি। আমি নিজেই কত বন্ধু, বড় ভাই, ছোট ভাইদের অ্যাশেজের গান শুনিয়ে তাদের ভক্ত বানিয়েছি। সে সময়টায় আমার ফেসবুক মানেই ছিলো জুনায়েদ ইভান আর অ্যাশেজ। প্রতিদিন কমপক্ষে একটা হলেও পোস্ট করতাম জুনায়েদ ইভানকে নিয়ে। আসলেই সে দিনগুলো কত সুন্দর ছিলো।
অনেকেই হয়তো এই গল্পগুলো শুনলে ভাবতে পারেন বানিয়ে বলছি। কিন্তু সত্যি কথা হলো অ্যাশেজ তথা জুনায়েদ ইভানের সাথে আমার সম্পর্কটা ছিলো আত্মার। সপ্তাহে কম করে হলেও ৫-৭ বার ফোনে কথা হত আমাদের। কিন্তু ব্যস্ততা আর জীবনের তাগিদে এখন সপ্তাহ, মাস কিংবা বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের আর আগের মত ফোনে কথা হয়না। কিছু দিনের ব্যবধানে আমাদের দেখাও হয়না। হয়না একসাথে পানশি'তে খাওয়ার সময়, হয়না এয়ারপোর্ট রোডে একসাথে আড্ডা দেওয়াটা। তবুও মনের কোণে ঠিকই জুনায়েদ ইভান মানুষটা আছে, থাকবে যতদিন বেঁচে আছি।
এই লেখাটা পড়লে তাঁরও হয়তো স্মৃতিচারণ হবে। অনেক কিছুই মনে পড়বে। আমার পুরনো ফেসবুক একাউন্টটা আর নেই, জুনায়েদ ইভানেরও আগের আইডি কিংবা পেজ কোনটাই নেই। আমাদের দুই ভাইয়ের কিছুটা স্মৃতি এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এখন মাঝেমধ্যে মনে হয় এত জনপ্রিয়, রকস্টার এই মানুষটা কতটা সাধারণ সেটা হয়তো আমি জানলেও কত মানুষ জানেনা, বুঝতে পারে না।
আজ ১৪ আগস্ট, জুনায়েদ ইভানের জন্মদিন। অনেক বছর হলো এখন আর সিলেটে কেক কেটে জুনায়েদ ইভানের জন্মদিন পালন করি না। তবুও আপনার জন্মদিনে এই অধমের পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য। আপনি আরো অনেক বড় হোন এই কামনা করি। আপনার জন্য এক বুক ভালোবাসা ♥


Comments
Post a Comment